আব্বুই আমার আম্মু
মোঃ তারিকুল ইসলাম
সন্তানরা মায়ের প্রচন্ড আদর এবং ভালোবাসার ধন। তাদেরই কোল আলোকিত করে তারা আসে পৃথিবীতে। সন্তান যখন মৃত্যুগর্ভে থাকে তখনতো মায়েদের কষ্টের সীমা থাকে না। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া এমনকি ঘুমাতেও পারে না। এতো কষ্টের পরেও সন্তান যখন তাদের কোলে আসে। সেই চাঁদ মুখ দেখে সবকিছুই ভুলে যায়া তারা। মহান আল্লাহ্ পাকের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি এই বাবা-মা। সীমাহীন কষ্টের পরেও তাদের প্রার্থনা আমার সন্তানেরা যেন ভালো থাকে। সকল বিপদ আপদ থেকে খোদা যেন তাদের রক্ষা করেন। মায়ের মুখের মিষ্টি হাসি, দেখবে এবার জগৎবাসি, কোল জুড়ে ঐ আসে যখন, মায়ায় ভরা মুখের হাসি। কোন কিছুতেই সন্তানের প্রতি মা-বাবার ভালোবাসাতে কমতি নেই। জন্ম থেকে শুধু কার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তারা পরম মায়ায় সন্তানদের লালন পালন করে থাকেন। বাইরে কনকনে শীত, ঠান্ডা বাতাস। মা তার সন্তানকে সবকিছুর উর্দ্ধে রাখার জন্য সর্বদা চেষ্টা করেন কিন্তু সন্তানেরা তা বুঝে উঠতে পারে না। সন্তান যখন কিছুই বুঝে না, সেই শিশু বয়সে যদি কেউ তার ‘মা’ কে হারায় তাহলে সেটা তার পক্ষে যতোটা কষ্টকর তার চাইতেও শতগুন বেশি কষ্টকর পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়া।
শান্তিপ্রিয় মানুষেরা সবসময় একটু স্বস্থি এবং ভালোবাসা চায়। আমাদের স্বর্গের একটি দরজা হলেন, আমাদের মা। অন্যটি বাবা। যে পরম সৌভাগ্যবান হয় সে দুইটি দরজা দিয়েই প্রবেশ করতে পারে। আবার অন্যান্য কেউ আছে, যে দুইটি দরজাই বন্ধ পায়। আমার মা যখন জান্নাতবাসী হলেন আমি তখন ছোট। মা আমাদের দুইটি ভাইকে একা রেখেই চলে গেলেন। মায়ের অনুপস্থিতিতে একজন বাবাকেযে কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরন আমার প্রিয় বাবা। মায়ের ইন্তেকালের পরে বাবাই আমাদের মা হয়ে গেলেন। তিনি আমাদের জন্য তাই শুরু করলেন যা যা একজন মমতাময় মা তার সন্তানের জন্য করে থাকে। যাই হোক এইচ.এস.সি পরীক্ষার টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করে বসলাম এক বিষয়ে। দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলাম। এইচ.এস.সি পরীক্ষায় ফেল করলাম না তবে রেজাল্ট ততটা ভালো করিনি। রেজাল্ট ভাল না হবার পেছনে প্রধান কারণ হলো পড়ালেখায় মনোনিবেশ না করতে পারা। পড়ার টেবিলে বসলেই শুধু চোখদিয়ে অঝোরে পানি ঝরতো। আসলে মনেই যদি শক্তি, সাহস না থাকে তাহলে দেহের শক্তি দিয়া খুব বেশি দুল যাওয়া যায় না। অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে বাবার কর্মক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হয়, ফলে আমরা প্রচন্ড আর্থিক সমস্যার মধ্যে পড়ে যাই। আমি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম না। চারিদিকে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার দেখছিলাম। দিনে দিনে আমার শুধু কষ্টই বাড়তে থাকে।
আমার মা মারা যাওয়ার পরে একটি বিষয় আমার মনে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। বিষয়টি নিয়ে আমি আমার ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজনদের সাথে খোলামেলা আলাপ আলোচনা করি। কিন্তু এটা এমনই একটি বিষয় যেটা বাবার সাথে যে কেউ চাইলেই খোলামেলা আলাপ আলোচনা করতে পারে না। বিষয়টি বাবাও আমিও জানি কিন্তু যখন সামনা সামনি কথা হয় তখন আমাদের মধ্যে এমন একটি ভাব যে, কেউ মোটেও বুঝি কিছুই জানি না। বিষয়টিকে বাবা মোটেও গুরুত্ব দেন নাই। তবে গুটিকয়েক আত্মীয়-স্বজন প্রাণপনে চেষ্টা করেছিলেন বাবাকে আবার বিয়ে দিতে। বাবা তাদের বলেছিলেন- আমার এখন একটাই কাজ ছেলেদের মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তোলা। আমার ২য় বিয়ের বিষয় এখানে না আসাই শ্রেয়। বাবা বললেন, আমারো ছোটবেলায় বাবা মারা যায়। আমি জানি ‘বাবা’ অথবা ‘মা’ দুইটির একটি না থাকলে কতোবড় কষ্টের। তাতে আবার অভাব। কেউ যেন বলতে না পারে যে, এদের ‘মা’ মারা যাওয়ার কারণে ছেলেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। আমার আত্মীয় স্বজনই আঙ্গুল তুলে বলবে, দ্বিতীয় বিয়ে করার কারণে এদের সংসারে শান্তি নেই। আমার ছেলে দুটি পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারলেই এই হবে আমার পরম পাওয়া।
আমি নতুন করে আমার সন্তানদের চোখেই পৃথিবীকে দেখতে চাই। আমার ছেলে যদি আমার থেকে দূরে সরে যায় তাহলে আমি আল্লাহর কাছে কি জবাব দিব? পরে বুঝতে পারলাম বাবা শুধু আমাদের নিয়েই থাকতে চায় তখন বাবার সাথে ধীরে ধীরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠলো। যেমনটা আগে ছিলনা। পরে বাবার ছোট-বড় যে কোন বিষয়ই শেয়ার করে নিতাম। আমার বাবাও চাইতেন আমরা সবসময়-তার খুব পাশাপাশি থাকি। বাবা এমনি করে আমাদেরকে নিয়ে সাত বছর পার করে দিলেন। বাবা বলেন আমাকে নিয়ে তোমরা ভেবোনা। সবদিকে শুধু নিজেরা তোমাদের পাশে দাড়াও। তাই আমার সুখ। এখন আমি এম.এ পড়ছি। বহুবার চেয়েছি বাবার বিয়ে দিতে। কিন্তু বাবা তাতে সায় দেন না। বাবা এখনও বলেন তোরা চাকরি কর। মানুষ হ, তার পরে না হয় কিছু করলাম। আল্লাহর রহমতে এখন বাবার সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক——-” একটি মজার ঘটনা দিয়ে শেষ করতে চাই—–
একদিন ইন্টারনেটের বিল দিতে গিয়ে ‘কাস্টোমার কেয়ার’ এর একটি মেয়েকে ভালো লেগে যায়। পরে বাবাকে এসে বলি- বাবা আজকে বিল দিতে গিয়ে একটি মেয়েকে আমার ভালো লেগেছে। তখন বাবা বলেন, এসব জায়গায় সুন্দর সুন্দর মেয়েদের চাকুরি দেয় তো তাই—-।
লেখকঃ শিক্ষক (ইংরেজি), রাজধানী আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ, ঢাকা